ইয়াবা গডফাদাররাই নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার

মিয়ানমার সীমান্তে ‘আইস’ তৈরির ২৫ কারখানা: ইয়াবা কারবারিরা দেশে ঢোকাচ্ছে ভয়ংকর মাদক

ইকবাল হাসান ফরিদ •

দেশে মাদকের ক্ষেত্রে ইয়াবার চেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে ‘আইস বা ক্রিস্টাল মেথ’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশকে টার্গেট করে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর এ মাদক তৈরির ২৫টি ছোট কারখানা।

এসব কারখানার মাদক চা পাতা, আচারের প্যাকেট এমনকি মাছে ব্যবহৃত বরফের আড়ালে টেকনাফ-উখিয়ায় পুরোনো ইয়াবা পাচারের রুট দিয়ে পাচার হয়ে দেশে আসছে। পরে তা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইয়াবার চেয়ে দামি ও ভয়ংকর এ মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ইয়াবা গডফাদাররাই করছে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারে জল এবং স্থল সীমান্ত রয়েছে ২৭০ কিলোমিটারের বেশি। এর মধ্যে স্থল সীমান্তই বেশি। স্থল সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ দুর্গম হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে থাকে না। আর এ সুযোগে মিয়ানমার থেকে সহজে দেশে ঢুকছে এসব মাদক।

বিজিবি সূত্র বলছে, মিয়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাচালান বন্ধে তারা নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় সড়ক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া আইস শনাক্তে ডগ স্কোয়াডকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাফিনুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেছেন, মিয়ানমার সীমান্তে মাদক চোরাকারবারিরা ইঁদুর-বিড়াল খেলছে। তাদের রুখতে বিজিবি সব সময় তৎপর রয়েছে। ইয়াবা-আইসের মতো ভয়ংকর মাদক রুখতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ধনীর দুলালরাই দেশে আইসের মতো দামি মাদক ব্যবহার করছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইন, মংডু ও শান এলাকায় যেখানে ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে, সেসব এলাকা থেকেই আইস আসছে। সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের বিভিন্ন বাড়িতে ছোট পরিসরে গড়ে উঠছে আইসের কারখানা।

এসব কারখানায় আগে ইয়াবা তৈরি হতো। মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা নামখামে দুটি কারখানা, কুনলংয়ে একটি, এক নম্বর ব্যারিকেড ট্যানগিয়ানে একটি, নামজাংয়ে দুটি, মাহাজা ও হোমোংয়ে দুটি, মংটনে তিনটি, মংসাতে দুটি, ত্যাছিলেকে তিনটি ও মংইয়াং এলাকায় চারটি কারখানা রয়েছে। এছাড়া পাংসাং এলাকায় দুটি, মওখামিতে দুটি ও কোকানে একটি কারখানা রয়েছে। এগুলোতে ইয়াবার পাশাপাশি এখন আইস তৈরি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) শুধু জানুয়ারিতেই ১০৫ কোটি টাকার আইস জব্দ করেছে। এরমধ্যে ৩০ জানুয়ারি কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন প্রায় ৯ কেজি আইস উদ্ধার করেছে।

যার বাজারমূল্য ৪৫ কোটি টাকা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিজিবি সদস্যরা ওইদিন উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখাল কাটা পাহাড় নামক স্থানে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেনের আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে তল্লাশি চালিয়ে ওই আইস উদ্ধার করা হয়।

এর আগে ২০ জানুয়ারি একই ব্যাটালিয়ন উখিয়ার পালংখালী বাজারে অভিযান চালিয়ে ২৫ কোটি টাকার পাঁচ কেজি আইস উদ্ধার করে। এছাড়া ১৪ ফেব্রুয়ারি বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অভিযানে ৫০ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়।

এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি বিজিবির রামু ব্যাটালিয়নের অভিযানে এক কেজি আইসসহ এক ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ৩৪ বিজিবির কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অভিযানে ১ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা আটক করা হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ১ লাখ ২ হাজার ৫৪০ পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে বিজিবি টেকনাফ ব্যাটালিয়ন।

পহেলা ফেব্রুয়ারি বিজিবি কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অভিযানে ৪ লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবাসহ এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, ‘আগের চেয়ে এখন তুলনামূলক বেশি চালান আটক হচ্ছে। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, যে পরিমাণ মাদক ধরা পড়ছে, তার ৯০ ভাগ অধরা থেকে যাচ্ছে।

জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া মূলত ইয়াবা ও আইস প্রবেশের মূল পয়েন্ট। সেখানকার স্থানীয় চিহ্নিত ও উঠতি মাদক ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের চক্রের সঙ্গে মিলেমিশে ইয়াবা ও আইসের চালান আনছে। এতে বড় ভূমিকা রাখছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এক শ্রেণির রোহিঙ্গা।

রোহিঙ্গা মাদক কারবারিরা স্থানীয়দের সঙ্গে নানা রকম আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে মাদক কারবার করে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে টেকনাফের বেশকিছু জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারও শেল্টার রয়েছে। তাদের অনেকেই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। বিজিবির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ইয়াবা ও আইসের মতো ভয়ংকর মাদক রুখতে বিজিবি জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে।